।। ওঁ জয়গুরু ওম্ ।।


জন্ম ও শিক্ষা লাভ


স্বামী নিগমানন্দের পূর্বাশ্রমের নাম ছিল নলিনীকান্ত চট্টোপাধ্য়ায়। পিতার নাম ভুবনমোহন এবং মাতার নাম মাণিকসুন্দরী। তিনি বাংলা ১২৮৭ সালে ৪ঠা ভাদ্র পবিত্র ঝুলন পূর্ণিমায় আবির্ভূত হইয়াছিলেন অবিভক্ত বাংলায় নদীয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার (বর্তমানে বাংলাদেশে মেহেরপুর জেলায়) রাধাকান্তপুর গ্রামে তাঁহার মাতুলালয়ে। পিতৃভূমি কুতুবপুর গ্রাম। তিনি মাতুলালয়ে থাকিয়া পড়াশুনা করিতেন। এই সময় তাঁহার মাতৃ বিয়োগ হয়। ঢাকা হইতে ওভারসিয়ারিং পাশ করিয়া তিনি সরকারী চাকুরীতে যোগদান করেন। Sathguru Nigamananda Paramhansa Saraswati

বিবাহ, চাকুরী ও ছায়ামূর্তি দর্শন


বাংলা ১৩০৪ সালে হালিশহরস্থ বৈদ্য়নাথ মুখোপাধ্য়ায়ের জ্য়েষ্ঠা কন্য়া অনিন্দ্য়সুন্দরী সুধাংশুবালার সহিত তাঁহার শুভ পরিণয় হয়। নলিনীকান্ত সরকারী চাকরী ছাড়িয়া দিনাজপুরের নারায়ণপুরে এক জমিদারী সেরেস্তায় সেটলমেন্টে বার জন আমিনের উপর সুপার ভাইজার পদে নিযুক্ত থাকাকালীন একদিন সন্ধ্য়ায় তাঁহার স্ত্রীর ছায়ামূর্তি দর্শন করিয়া আশ্চর্য হইলেন। ছায়ামূর্তি দর্শনের প্রায় দেড় ঘন্টা পূর্বে কুতবপুরে সুধাংশুবালা দেহ রক্ষা করিয়াছিলেন। এমনিভাবে নলিনীকান্ত আরও দুই তিন বার ছায়ামূর্তি দর্শন করিয়া পাগল প্রায় হইয়া যান। এখন তাঁহার পরলোকে বিশ্বাস হইল। তিনি পুনরায় সুধাংশুবালাকে পাইবার জন্য় এবং পরলোক তত্ত্বানুসন্ধানে ইতস্ততঃ করিতে লাগিলেন।

প্লান্চেট, মেস্মেরিজম, মেডিয়ম, হিপনোটিজম আদি শিক্ষা


কর্মক্ষেত্র হইতে কিছু দিনের জন্য়ে বিশ্রাম লইয়া তিনি মাদ্রাজ যান, সেখানে আডিয়ারে থিওসোফিকাল সোসাইটী অফ্ ইন্ডিয়ার অধ্য়ক্ষ লেড বিটর সাহেবের অধীনে তিনি প্লানচেট, মেসমেরিজম, মেডিয়াম, হিপনোটিজম আদি শিক্ষা করেন। একদিন মেডিয়াম মধ্য় দিয়া তাঁহার পরলোকগতা পত্নী সুধাংশুবালার সঙ্গে কথোপকথন করেন এবং পূর্ব সুর ও মূর্চ্ছনায় তাঁহার একটি গোপন সংগীত শ্রবণ করেন। তাহাতে তিনি সন্তুষ্ট হইতে পারেন নাই। তিনি পুনরায় তাঁহাকে দর্শন করিতে চান।

স্বপ্নে মন্ত্রপ্রাপ্তি ও তন্ত্রসাধনায় সিদ্ধিলাভ


স্বামী পূর্ণানন্দ পরমহংস হইতে পরামর্শ পাইয়া নলিনীকান্ত কর্মক্ষেত্রে ফিরিয়া যান। একদিন রাত্রে একান্তভাবে একটি রুদ্ধ প্রকোষ্ঠের মধ্য়ে স্বপ্নে বিল্বপত্রে রক্তচন্দনে লিখিত একাক্ষরী বুধবীজ বা স্ত্রীং এই মন্ত্র পান। এই মন্ত্রের জপ বা সাধনা বিষয়ে বহু পন্ডিত ও সাধুদের নিকট জানিতে যাইয়া তিনি হতাশ হইলেন। কাশীতে প্রাণ বিসর্জনের সংকল্প লইলেন। সেই দিন স্বপ্নাদিষ্ট হইয়া বাংলার বীরভূম জেলার তারাপীঠের নাদসিদ্ধ মহাসাধক বামাক্ষেপার নিকট আসেন। তাঁহার নিকট হইতে উক্ত মন্ত্রে অভিষিক্ত হইয়া মাত্র একুশ দিনের মধ্য়ে তন্ত্র সাধনায় সিদ্ধি লাভ করিয়া মা তারাকে প্রাপ্ত হন। ইহার পর তিনি গুরুদেবের নিকট গেলেন।

সাধনার সঙ্কেত


বামাক্ষেপা নলিনীকান্তের নিকট হইতে সব শুনিয়া ক্ষুব্ধ হইলেন। রাত্রিযোগে মা তারা বামাক্ষেপাকে বলিলেন-"নলিনীকান্ত আমার পরম ভক্ত। আমি তাহার মধ্য় দিয়া অন্য়ান্য় সাধনা করাইতে চাই। তাহাকে জগতগুরুর আসনে বসাইতে চাই। তুই বল সে সংসার ত্য়াগ করিয়া বৈদিক সন্ন্য়াস গ্রহণ করিয়া নিস্ত্রৈগুণ্য় সাধনা করিবে।" তাহাই হউক। নলিনীকান্ত সংসার ত্য়াগ করিলেন।

জ্ঞানীগুরুলাভ, সন্ন্য়াসদীক্ষা ও জ্ঞানসিদ্ধি


নলিনীকান্ত রাজস্থান যাইয়া সেখানে একটি ধর্মীয় সভায় স্বপ্নে মন্ত্রদাতা গুরু সাবিত্রী পাহাড়ের পুষ্কর তীর্থের স্বামী সচ্চিদানন্দ পরমহংসদেবের দর্শনলাভ করিলেন এবং তাঁহার আশ্রমে বসবাস করিলেন। সচ্চিদানন্দ তাঁহাকে বৈদিক সন্ন্য়াস দীক্ষা দিয়া নাম দিলেন স্বামী নিগমানন্দ সরস্বতী। গুরুদেবের নির্দেশে শঙ্করাচার্যের প্রতিষ্ঠিত চারটি মঠ পদব্রজে পরিক্রমা করিয়া বেদের মহাবাক্য় চতুষ্টয় বিচার করিলেন। জ্ঞানসিদ্ধির পর গুরুদেবের নির্দেশে অপরোক্ষানুভূতি লাভের জন্য় পুনরায় যোগীগুরু অন্বেষণে কলিকাতা হইয়া পরশুরাম তীর্থে গেলেন।

যোগীগুরু লাভ ও নির্বিকল্প সমাধি প্রাপ্তি


পরশুরাম তীর্থে আসিয়া তিনি আন্ত্রিকে আক্রান্ত হন। একদিন রাত্রে তিনি একটি বৃক্ষের কোটরে বাস করিয়া পরের দিন সকালে তাঁহার নির্দিষ্ট যোগীগুরু সুমেরদাসের সহিত হিমালয়ের গুম্ফায় গেলেন। তথায় যোগশিক্ষা করিয়া গুরুদেবের নির্দেশে মেদিনীপুর এবং গৌহাটি যাইয়া যজ্ঞেশ্বর বিশ্বাসের বাড়িতে অবস্থান করেন। সেখানে সবিকল্প সমাধি লাভ করিয়া কামাখ্য়াতে নির্বিকল্প সমাধি লাভ করেন।

প্রেমসমাধি লাভ ও পরমহংস উপাধি প্রাপ্তি


কাশীতে অন্নপূর্ণাকে পরীক্ষা করিতে আসিয়া তাঁহার সাধনা অপূর্ণ ও জ্ঞান অপূর্ণ জানিয়া তিনি মুসৌরী পাহাড়ের প্রেমসিদ্ধা গৌরীমায়ের নিকট গমন করেন। তাঁহার নিকট হইতে প্রেমসমাধি অভ্য়াস করিয়া নিগমানন্দ উজ্জয়িনী কুম্ভমেলায় গুরুদেবের দর্শনে আসিলেন। সাধুমন্ডলীর অনুমোদনে সচ্চিদানন্দ তাঁহাকে পরমহংস ও পরিব্রাজকাচার্য উপাধিতে ভূষিত করেন।

গারোহিল্স যোগাশ্রমে প্রেমিকের বাসরঘর


পরমহংস ও পরিব্রাজকাচার্য উপাধিতে ভূষিত হইয়া নিগমানন্দ গারোহিল্স যোগাশ্রমে বাস করেন। মহামায়া তাঁহার সহিত অভিন্নভাবে বাস করিতে লাগিলেন। এখানে তিনি মহামায়ার সহিত চুক্তি করিয়া গুরুগিরির জন্য় লোকালয়ে আসিলেন। তাঁহার শ্রীচরণাশ্রিত শিষ্য় মাত্র মুক্তি পাইতে একজন্ম হইতে তিনজন্ম লাগিবে।

গ্রন্থ রচনা ও আর্য্য়দর্পণ প্রকাশন


ঠাকুর নিগমানন্দ "যোগীগুরু", "জ্ঞানীগুরু", "তান্ত্রিকগুরু", "প্রেমিকগুরু", "ব্রহ্মচর্য সাধন", "বেদান্তবিবেক", "তত্ত্বমালা" আদি গ্রন্থ রচনা করিয়াছেন। "আর্য্য়দর্পণ" নামে একটি মাসিক সনাতন ধর্মের মুখপত্র প্রকাশ করিয়াছেন বাংলা ১৩১৫ সাল হইতে।

মঠাশ্রম প্রতিষ্ঠা ও সার্বভৌম ভক্তসম্মিলনী প্রবর্তন


তিনি আসাম-বঙ্গীয় সারস্বত মঠ, সারস্বত আশ্রম, সারস্বত সংঘ আদি প্রতিষ্ঠা করিয়াছেন। বাংলা ১৩২২ সালে ভক্তসম্মিলনী প্রবর্তন করিয়াছেন। সমস্ত সম্পত্তি ট্রাষ্টবোর্ডের হাতে সমর্পণ করিয়াছেন। তিনি "জয়গুরু" মহানামের প্রবর্তক এবং জ্ঞানচক্র প্রদাতা।

নিগমানন্দ দর্শন


তাঁহার মতবাদ হইল - শঙ্করের মত ও গৌরাঙ্গের পথ। অর্থাৎ অদ্বৈত ব্রহ্মবাদে তিনি বিশ্বাসী কিন্তু ভক্তিপথে। ভক্তিপথে জ্ঞানলাভ করাকে তিনি শঙ্করের মত আর গৌরাঙ্গের পথ বলিয়াছেন।

মহাপ্রয়াণ


তন্ত্র, জ্ঞান, যোগ ও প্রেম - এই চতুঃসাধনসিদ্ধ নির্বিকল্প সমাধি ব্যুথিত মহাসাধক নিগমানন্দ বাংলা ১৩৪২ সাল ১৩ই অগ্রহায়ণ শুক্রবার ১-১৫ মিনিটে কলিকাতার বিডন ষ্ট্রীটে মহাসমাধি গ্রহণ করিয়াছেন। তাঁহার পবিত্র দেহ পতিতপাবনী ভাগীরথী কূলে মহামায়া সুধাংশুবালার জন্মভূমি হালিশহরে বর্তমান আসাম-বঙ্গীয় সারস্বত মঠে গুরুব্রহ্ম আসন মন্দির সন্নিকটস্থ স্থানে সমাধিস্থ করা হয় এবং তাঁহার উপর একটি সমাধি মন্দির নির্মাণ করিয়া তাঁহার মর্মর মূর্তি প্রতিষ্ঠা করা হইয়াছে। ঠাকুর নিগমানন্দদেবের প্রবর্তিত পথে অগণিত ত্রিতাপক্লিষ্ট নর-নারী পরিচালিত হইয়া নিজেদের জীবনকে ধন্য় মনে করিতেছেন। জয়গুরু।